আরিফ হোসেন রাজশাহী :
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এদিনে ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯ মিনিটের এক জাদুকরি ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বপ্নে বিভোর করেছিলেন।
তাঁর ভাষণে তিনি স্বাধীনতার যে ডাক দিয়েছিলেন তা বাঙালির মনে সারাজীবন অণুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকবে। তৎকালীন শোষিত, বঞ্চিত, মুক্তিকামী ও লাঞ্ছিত জনগনকে আন্দোলনের ডাক দেয়া তাঁর ঐতিহাসিক সেই ভাষণে সাড়া দিয়েছিলেন লাখ লাখ জনতা।
কালজয়ী এই ভাষণে আগুন ঝরা কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মূলত ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতা।
সঙ্গত কারণে এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কারণ ৭ই মার্চের ভাষণের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ভাষণ তাই মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার এক অনন্য উৎস।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ভাষণের তাৎপর্য কতটা তা হয়তাে ভাষণটি শুনলেই বুঝা যায়। ভাষণটি শুনলেই যেন শরীরের ভিতর আবারও যুদ্ধের বাসনা জেগে উঠে। ঠিক যেমন ১৯৭১ জেগে উঠে ছিল আমাদের দামাল ছেলেদের মনে। মূলত ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের তাৎপর্য অনেক গভীর।
৭ মার্চ, ১৯৭১। দিনটি কি শুধুই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সে ভাষণে সীমাবদ্ধ? না। দিনটি শোষণের শেকলে অবরুদ্ধ বাঙ্গালির মুক্তির পথ খুলে দেয়ার দিন। একদিকে দিনটি মুক্তিকামী বাঙ্গালিকে যেমন উজ্জীবিত করেছিল মুক্তির জন্য, তেমনি সূচনা ঘটিয়েছিল পাকিস্তানিদের পতনের।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ।
‘লাথি মার, ভাঙরে তালা! যত সব বন্দিশালায়-আগুন-জ্বালা’। কবি নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ কবিতার এ পঙক্তিটিই যেন প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছিল রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ১০ লাখ মানুষের হৃদয়ে। এক হাজার ১০৮ শব্দে ১৮ মিনিটের এ ভাষণটি উজ্জীবিত করেছিল ২৩ বছরের বঞ্চিত, অবহেলিত ও শোষিত বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে।
’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, আগরতলা মামলায় জড়ানো এবং ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় – প্রত্যেকটি বিষয়কে শক্তি হিসেবে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তার ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন, যা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। এটি পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে ইউনেস্কোর ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
দেশবাসীকে জাগ্রত করার প্রশ্নে, নিপীড়িত জনতার মুক্তির প্রশ্নে, স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নে, জাতি গঠনের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের প্রভাব অপরিসীম, তা বলতেই হয়। নিউজ উইক ম্যাগাজিন তাই এ ভাষণকে কবিতা আর শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে উল্লেখ করেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিঃসন্দেহে ছিল বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করার কবিতা।
ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে একদিকে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলছিল, ঠিক অন্যদিকে লেখা হচ্ছিল পাকিস্তানি শাসকদের পতনের ইতিহাস। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর পরেই অকুতোভয় বাঙালি এবং সর্বস্তরের মানুষ শক্তি পেয়েছিল মুক্তির চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্যে। তাই বলাই যায়, ৭ মার্চ এবং স্বাধীনতা যেন একই সূত্রে গাঁথা।
’৭০-এর নির্বাচনে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত গণভোটে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের দাবিদার হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং সামরিক কুচক্রীদের অপপ্রচারে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ না জানিয়ে নানা টালবাহানা করছিল। নানা বাহানায় সময়ক্ষেপণ করছিল, আর নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য এবং অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) নিয়ে আসছিল।
এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসীম ধৈর্য আর প্রজ্ঞা নিয়ে ধাপে ধাপে ইতিহাসের পথে পা ফেলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় দেয়া ভাষণে জনগণকে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, জনগণকে যেভাবে একতাবদ্ধ করেছিলেন, উদ্বেলিত করেছিলেন, তা মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে বিরল।
পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তৎকালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন: পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠী চিন্তিত হয়ে কূটকৌশলের আশ্রয় নিল। ৭ মার্চের একদিন আগে, অর্থাৎ ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। জেনারেল ইয়াহিয়া তার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের আংশিক ব্যাখ্যা করলে প্রতীয়মান হয়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন, আবার যুদ্ধে কীভাবে জয়ী হতে হবে, সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকার প্রধানের মতো একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট, যা যা আছে, সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে
৭ মার্চ ১৯৭১ সাল বাঙালির মহাকাব্য