কলামিস্ট মাহমুদ আহমদ:
পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে একজন ইমামের গুরুত্ব অনেক। এক কথায় বলা যায় একজন আদর্শবান ইমাম হচ্ছেন প্রকৃত মানুষ গড়ার কারিগর। তিনি যুগের চাহিদা অনুযায়ী সমাজের লোকদের দিক নির্দেশনা প্রদান করে আলোর দিকে নিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তিনি পারেন কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূর করে আধুনিক সভ্য সমাজ গড়ে তুলতে। মাহমুদ আহমদ যেভাবে হজরত রাসুল করিম (সা.) অন্ধকার যুগকে আলোকময় করেছিলেন আর পশুসুলভ মানুষগুলো ফেরেশতার মতো হতে পেরেছিলে। কিন্তু আজ আমরা কী দেখছি? প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শত শত ধমীর্য় ওয়াজ আপলোড হচ্ছে আর সেগুলো মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কার ওয়াজ কতটা লাইক, ভিউ আর ভাইরাল হয়েছে তা নিয়ে হিসাব কষতে সবাই ব্যস্ত কিন্তু এটা কেউ একবারের জন্যও ভাবেননা আমার ওয়াজটি কজনকে দ্বীনের পথে আনতে সহায়ক হয়েছে বা কজনের হৃদয় পরিবর্তনের কাজ করেছে।
কথায় কথায় কাফের আর নাস্তিক বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি। আমরা লক্ষ্য করছি একশ্রেণির আলেম আছেন, যারা কেবল ইউটিউব আর ফেসবুকে ভাইরাল হবার জন্যই ওয়াজ করেন আর উদ্দেশ্যই থাকে সেগুলো থেকে অর্থ উপার্জন যা মোটেও ঠিক নয়। ইউটিউবে ওয়াজ থেকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হচ্ছে বিজ্ঞাপন। কিন্তু যেসব বিজ্ঞাপন ওয়াজের কয়েক মিনিট পর পর ভেসে ওঠে সেগুলো আদৌ শরিয়তসম্মত কি না, তা কি এসব আলেমরা একবারের জন্যও ভেবে দেখেছেন? ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে অর্থ-উপার্জন করা বৈধ হবে কি না? এ বিষয়ে কতক আলেমের মতামত হলো নিজের বানানো ভিডিওর সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন যুক্ত করার বিনিময়ে ইউটিউব থেকে অর্থ উপার্জনের বিষয়টি নিরাপদ নয়।
কারণ ইউটিউব কখন কোন ধরনের এবং কোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেবে তাতে ভিডিওদাতার এখতিয়ার থাকে না বরং এসব কিছু ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ বাছ বিচার ছাড়া যে কোনো বিজ্ঞাপন যুক্ত করে অর্থ উপার্জন বৈধ নয়। বরং অর্থ উপার্জন বৈধ হওয়ার বিষয়টি কিছু শর্তাবলীর ওপর নির্ভর করে। ১. যে বিষয়ের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে সেটি বৈধ হওয়া। ২. বিজ্ঞাপনের চিত্র শরীয়ত পরিপন্থী না হওয়া। ৩. বিজ্ঞাপন ও এর ভাষা এবং উপস্থাপনের মধ্যে কোনো ধরনের ধোঁকা বা প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া ইত্যাদি। আর সাধারণত যেহেতু এসব শর্তাবলী রক্ষা করা ভিডিওদাতার পক্ষে সম্ভব হয় না, তাই এ ধরনের উপার্জন থেকে বিরত থাকা উচিত। ধোকা বা প্রতারণা মাধ্যমে আয়কে কিতাবুল আছল ৪/২০; বাদায়েউস সানায়ে ৪৪৬; ফিকহুন নাওয়াযিল ৩/২৮৪ এ বর্ণনা অনুযায়ী অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান কতক নামধারী আলেম এমনভাবে ইউটিউব বা ফেসবুকে মিথ্যা হেডলাইন বা থাম্বনেইল উপস্থাপন করে যা সাধারণ মানুষ সহজেই প্রতারিত হয়। তারা সোস্যাল মিডিয়ায় হাজার হাজার এমন হেডলাইন দিয়ে সংবাদ আপলোড করছেন যার সাথে কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া কি কোনোভাবে জায়েজ হতে পারে?
কোনো অবস্থাতেই মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ইসলামে জাযেজ নেই। মিথ্যা ইসলামের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও হারাম গোনাহগুলোর অন্যতম। মিথ্যা সর্বাবস্থায় হারাম। পবিত্র কুরআনে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, হক না হকের এই মিশ্রণ থেকে বারণ করা হয়েছে। মিথ্যুক আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন ‘অতঃপর আমরা সবাই (আল্লাহর কাছে) এ মর্মে প্রার্থনা করি যে মিথ্যুকদের ওপর আল্লাহর লানত পতিত হোক।’ (সুরা : আলে ইমরান,আয়াত: ৬১) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে সত্য গোপন করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৪২) তাইতো এসব ওয়াজ থেকে প্রশান্তি পাইনা হৃদয়ে । হাদিসে উল্লেখ আছে, হজরত আবু মুসা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান ও হেদায়াতসহ প্রেরণ করেছেন তার উপমা বারিধারার মতো, যা একটি জমির ওপর বর্ষিত হয়েছে। তার একটি অংশ ভালো যা পানিকে গ্রহণ করে নিয়েছে। ফলে তা বিপুল পরিমাণ ঘাস ও গাছ উৎপন্ন করেছে। এর একটা অংশ ছিল নিচু, সেখানে তা পানি আটকিয়ে নিয়েছে, আর ওথেকে আল্লাহ লোকদেরকে উপকৃত করেছেন, তা থেকে তারা পান করেছে, জীবজন্তুকে পান করিয়েছে এবং পানি সেচ করে কৃষি কাজও করেছে। আবার এই বারিধারা এমন এক অংশে পৌঁছেছে যেটি ছিল অনুর্বর, সমতল ময়দান। তা পানি ধরে রাখতে পারেনি এবং তার ঘাস উৎপন্ন করার ক্ষমতাও নেই। প্রথমটি হচ্ছে ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত, যে আল্লাহর দীনের জ্ঞান লাভ করেছে এবং আল্লাহ যে জ্ঞান দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন তা থেকে সে লাভবান হয়েছে। কাজেই সে তা শিখেছে ও অন্যকে শিখিয়েছে। অপর দৃষ্টান্তটি হচ্ছে এমন এক ব্যক্তির, যে এই জ্ঞানের দিকে দৃষ্টি দেয়নি এবং আল্লাহ আমাকে যে হেদায়াতসহ পাঠিয়েছেন তা গ্রহণ করেনি।’ (বোখারি) উল্লিখিত হাদিসটিতে আল্লাহর রাসুল (সা.) তিন ধরনের জ্ঞানী ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম দুই দল আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান লাভ করে লাভবান হয়েছে। তাদের একদল জ্ঞান অর্জন করে নিজেদের সংশোধন করেছেন কিন্তু সাধারণ মানুষের সংশোধনের প্রতি দৃষ্টিপাত করেননি। দ্বিতীয় দলটি জ্ঞান দ্বারা নিজেরা লাভবান হবার সাথে সাথে অন্যদেরকে উপকৃত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ এ উম্মতের বুযুগার্নে দীন। আর তৃতীয় দল হলো তারা, যারা জ্ঞান পেয়েও নিজেদের সংশোধন করেনি ও তা থেকে উপকৃতও হয়নি। আজ আমাদের ধমীর্য় সমাজে ওই তৃতীয় শ্রেণির জ্ঞানীদের সংখ্যাই মনে হয় বেশি। তারা ধর্মের জ্ঞানকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ধর্মে মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে, ধর্মে নতুন রীতিনীতি প্রবেশ ঘটিয়েছে এবং ধর্মের নামে নানান অপকর্মও করে বসে। ওয়াজে শুধু কাফের ফতোয়ার ছড়াছড়ি আর ওয়াজে চলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন। শুধু তাই নয় অশ্লীল মিথ্যা গল্পের চটকদার বয়ান দিয়ে ভাইরাল হওয়াই যেন তার মূল লক্ষ্য।
এ ছাড়া কোরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা করে মানুষের মাঝে ফিতনা ও ফাসাদ এবং ঐক্যের তান ছিঁড়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে শান্তিসময় সমাজকে অশান্ত করতেও দেখা যায়। যদিও এই সংখ্যাটা বেশি নয় কিন্তু গুটিকতক লোকদের জন্য সমাজের একটি বড় অংশকে এর মাশুল দিতে হয়। আগে ওয়াজ মাহফিল থেকে ধমীর্য় কত সুন্দর সুন্দর বয়ান শুনে ঘরে ফিরতাম কিন্তু এখন কি হচ্ছে? কেন জানি এখন আর ধমীর্য় বয়ানগুলোতে সেই আধ্যাত্মিক তৃপ্তি লাভ করি না। যুব সমাজ আজ হরেকরকম অপকর্মে লিপ্ত, নেশায় মত্ত হয়ে পিতামাতাকেও খুন করছে, তাদের কেউ কেউ। প্রতিনিয়ত পারিবারিক কলহে কত সুখের ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিপদগামী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনতে আর পরিবারগুলোকে শান্তিময় করার লক্ষ্যে একজন আলেম অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু তারা তা না করে কীভাবে সহজে ভাইরাল হয়ে অর্থ উপার্জন করবেন সেই চিন্তায় ওয়াজে কখনও হিন্দি গানের সুর টানেন আবার কখনও বাংলা গানের। প্রত্যেক আলেমের কয়েকটি করে চ্যানেল থাকে সেগুলোতে মিথ্যা হেডলাইন দিয়ে এসব বক্তব্য প্রচার করে ছড়িয়ে দেন। যেহেতু তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে দ্বীনের পথে আনা নয় তাই তাদের এসব ওয়াজ মানুষের আধ্যাত্মিক পরিবর্তনে কোন প্রভাব ফেলে না। এছাড়া এই নামধারী আলেমরা মানুষকে যে নসীহত করেন তা নিজেই পালন করেন না। বিশ্বনবী (সা.) যে পশুতুল্য মানুষকে ফেরেশতায় রূপায়ীত করেছিলেন, তা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? তা হয়েছিল কেবলমাত্র তার উত্তম আদর্শ, উত্তম নসিহত আর অন্ধকার রাতের দোয়া। তিনি তার উম্মতকে যে নসীহত করতেন প্রথমে তা নিজে আমল করে দেখাতেন। যার ফলে তার নসীহত জাদুর মত কাজ করতো। তাই যারা ওয়াজ নসীহত করেন তাদেরকে প্রথমে হতে হবে উত্তম আদর্শের। যারা সমাজের পথপ্রদর্শক তাদের আদর্শ হতে হবে সবার চেয়ে উত্তম। একজন আদর্শবান ইমাম হচ্ছেন সমাজ ও দেশের বড় মূল্যবান সম্পদ।
এক জন আদর্শবান ইমাম চেষ্টা করলে পারেন গোটা সমাজকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে। মহানবী (সা.) ও তার খলীফাদের মৃত্যুর পর ইসলামের প্রচার প্রসার ইমামদের মাধ্যমেই হয়েছিল। ইসলামের আদর্শবান ইমামরা প্রকৃত ইসলামকে প্রচার করে কায়েম করেছিলেন একটি আধুনিক সমাজ ও দেশ। যিনি প্রকৃত আলেম তিনি সত্য বলতে কখনও দ্বিধা করবেন না এবং যা অন্যকে পালন করতে বলবেন তা প্রথমে নিজে করবেন। ইসলামি শিক্ষা এক মুসলমানকে শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী এবং মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই শিক্ষা ভুলে পরস্পর হানাহানির নীতি কোনো ক্রমেই ইসলাম সমর্থন করে না। ওয়াজ নসীহতে ফিরে আসুক প্রাণ আর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে গড়ে উঠুক সম্প্রীতির মেলবন্ধন"
পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে একজন ইমামের গুরুত্ব অনেক। এক কথায় বলা যায় একজন আদর্শবান ইমাম হচ্ছেন প্রকৃত মানুষ গড়ার কারিগর। তিনি যুগের চাহিদা অনুযায়ী সমাজের লোকদের দিক নির্দেশনা প্রদান করে আলোর দিকে নিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তিনি পারেন কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূর করে আধুনিক সভ্য সমাজ গড়ে তুলতে। মাহমুদ আহমদ যেভাবে হজরত রাসুল করিম (সা.) অন্ধকার যুগকে আলোকময় করেছিলেন আর পশুসুলভ মানুষগুলো ফেরেশতার মতো হতে পেরেছিলে। কিন্তু আজ আমরা কী দেখছি? প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শত শত ধমীর্য় ওয়াজ আপলোড হচ্ছে আর সেগুলো মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কার ওয়াজ কতটা লাইক, ভিউ আর ভাইরাল হয়েছে তা নিয়ে হিসাব কষতে সবাই ব্যস্ত কিন্তু এটা কেউ একবারের জন্যও ভাবেননা আমার ওয়াজটি কজনকে দ্বীনের পথে আনতে সহায়ক হয়েছে বা কজনের হৃদয় পরিবর্তনের কাজ করেছে।
কথায় কথায় কাফের আর নাস্তিক বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি। আমরা লক্ষ্য করছি একশ্রেণির আলেম আছেন, যারা কেবল ইউটিউব আর ফেসবুকে ভাইরাল হবার জন্যই ওয়াজ করেন আর উদ্দেশ্যই থাকে সেগুলো থেকে অর্থ উপার্জন যা মোটেও ঠিক নয়। ইউটিউবে ওয়াজ থেকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হচ্ছে বিজ্ঞাপন। কিন্তু যেসব বিজ্ঞাপন ওয়াজের কয়েক মিনিট পর পর ভেসে ওঠে সেগুলো আদৌ শরিয়তসম্মত কি না, তা কি এসব আলেমরা একবারের জন্যও ভেবে দেখেছেন? ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে অর্থ-উপার্জন করা বৈধ হবে কি না? এ বিষয়ে কতক আলেমের মতামত হলো নিজের বানানো ভিডিওর সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন যুক্ত করার বিনিময়ে ইউটিউব থেকে অর্থ উপার্জনের বিষয়টি নিরাপদ নয়।
কারণ ইউটিউব কখন কোন ধরনের এবং কোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেবে তাতে ভিডিওদাতার এখতিয়ার থাকে না বরং এসব কিছু ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ বাছ বিচার ছাড়া যে কোনো বিজ্ঞাপন যুক্ত করে অর্থ উপার্জন বৈধ নয়। বরং অর্থ উপার্জন বৈধ হওয়ার বিষয়টি কিছু শর্তাবলীর ওপর নির্ভর করে। ১. যে বিষয়ের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে সেটি বৈধ হওয়া। ২. বিজ্ঞাপনের চিত্র শরীয়ত পরিপন্থী না হওয়া। ৩. বিজ্ঞাপন ও এর ভাষা এবং উপস্থাপনের মধ্যে কোনো ধরনের ধোঁকা বা প্রতারণার আশ্রয় না নেয়া ইত্যাদি। আর সাধারণত যেহেতু এসব শর্তাবলী রক্ষা করা ভিডিওদাতার পক্ষে সম্ভব হয় না, তাই এ ধরনের উপার্জন থেকে বিরত থাকা উচিত। ধোকা বা প্রতারণা মাধ্যমে আয়কে কিতাবুল আছল ৪/২০; বাদায়েউস সানায়ে ৪৪৬; ফিকহুন নাওয়াযিল ৩/২৮৪ এ বর্ণনা অনুযায়ী অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান কতক নামধারী আলেম এমনভাবে ইউটিউব বা ফেসবুকে মিথ্যা হেডলাইন বা থাম্বনেইল উপস্থাপন করে যা সাধারণ মানুষ সহজেই প্রতারিত হয়। তারা সোস্যাল মিডিয়ায় হাজার হাজার এমন হেডলাইন দিয়ে সংবাদ আপলোড করছেন যার সাথে কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া কি কোনোভাবে জায়েজ হতে পারে?
কোনো অবস্থাতেই মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ইসলামে জাযেজ নেই। মিথ্যা ইসলামের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও হারাম গোনাহগুলোর অন্যতম। মিথ্যা সর্বাবস্থায় হারাম। পবিত্র কুরআনে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, হক না হকের এই মিশ্রণ থেকে বারণ করা হয়েছে। মিথ্যুক আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন ‘অতঃপর আমরা সবাই (আল্লাহর কাছে) এ মর্মে প্রার্থনা করি যে মিথ্যুকদের ওপর আল্লাহর লানত পতিত হোক।’ (সুরা : আলে ইমরান,আয়াত: ৬১) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে সত্য গোপন করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৪২) তাইতো এসব ওয়াজ থেকে প্রশান্তি পাইনা হৃদয়ে । হাদিসে উল্লেখ আছে, হজরত আবু মুসা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান ও হেদায়াতসহ প্রেরণ করেছেন তার উপমা বারিধারার মতো, যা একটি জমির ওপর বর্ষিত হয়েছে। তার একটি অংশ ভালো যা পানিকে গ্রহণ করে নিয়েছে। ফলে তা বিপুল পরিমাণ ঘাস ও গাছ উৎপন্ন করেছে। এর একটা অংশ ছিল নিচু, সেখানে তা পানি আটকিয়ে নিয়েছে, আর ওথেকে আল্লাহ লোকদেরকে উপকৃত করেছেন, তা থেকে তারা পান করেছে, জীবজন্তুকে পান করিয়েছে এবং পানি সেচ করে কৃষি কাজও করেছে। আবার এই বারিধারা এমন এক অংশে পৌঁছেছে যেটি ছিল অনুর্বর, সমতল ময়দান। তা পানি ধরে রাখতে পারেনি এবং তার ঘাস উৎপন্ন করার ক্ষমতাও নেই। প্রথমটি হচ্ছে ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত, যে আল্লাহর দীনের জ্ঞান লাভ করেছে এবং আল্লাহ যে জ্ঞান দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন তা থেকে সে লাভবান হয়েছে। কাজেই সে তা শিখেছে ও অন্যকে শিখিয়েছে। অপর দৃষ্টান্তটি হচ্ছে এমন এক ব্যক্তির, যে এই জ্ঞানের দিকে দৃষ্টি দেয়নি এবং আল্লাহ আমাকে যে হেদায়াতসহ পাঠিয়েছেন তা গ্রহণ করেনি।’ (বোখারি) উল্লিখিত হাদিসটিতে আল্লাহর রাসুল (সা.) তিন ধরনের জ্ঞানী ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম দুই দল আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান লাভ করে লাভবান হয়েছে। তাদের একদল জ্ঞান অর্জন করে নিজেদের সংশোধন করেছেন কিন্তু সাধারণ মানুষের সংশোধনের প্রতি দৃষ্টিপাত করেননি। দ্বিতীয় দলটি জ্ঞান দ্বারা নিজেরা লাভবান হবার সাথে সাথে অন্যদেরকে উপকৃত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ এ উম্মতের বুযুগার্নে দীন। আর তৃতীয় দল হলো তারা, যারা জ্ঞান পেয়েও নিজেদের সংশোধন করেনি ও তা থেকে উপকৃতও হয়নি। আজ আমাদের ধমীর্য় সমাজে ওই তৃতীয় শ্রেণির জ্ঞানীদের সংখ্যাই মনে হয় বেশি। তারা ধর্মের জ্ঞানকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ধর্মে মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে, ধর্মে নতুন রীতিনীতি প্রবেশ ঘটিয়েছে এবং ধর্মের নামে নানান অপকর্মও করে বসে। ওয়াজে শুধু কাফের ফতোয়ার ছড়াছড়ি আর ওয়াজে চলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন। শুধু তাই নয় অশ্লীল মিথ্যা গল্পের চটকদার বয়ান দিয়ে ভাইরাল হওয়াই যেন তার মূল লক্ষ্য।
এ ছাড়া কোরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা করে মানুষের মাঝে ফিতনা ও ফাসাদ এবং ঐক্যের তান ছিঁড়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে শান্তিসময় সমাজকে অশান্ত করতেও দেখা যায়। যদিও এই সংখ্যাটা বেশি নয় কিন্তু গুটিকতক লোকদের জন্য সমাজের একটি বড় অংশকে এর মাশুল দিতে হয়। আগে ওয়াজ মাহফিল থেকে ধমীর্য় কত সুন্দর সুন্দর বয়ান শুনে ঘরে ফিরতাম কিন্তু এখন কি হচ্ছে? কেন জানি এখন আর ধমীর্য় বয়ানগুলোতে সেই আধ্যাত্মিক তৃপ্তি লাভ করি না। যুব সমাজ আজ হরেকরকম অপকর্মে লিপ্ত, নেশায় মত্ত হয়ে পিতামাতাকেও খুন করছে, তাদের কেউ কেউ। প্রতিনিয়ত পারিবারিক কলহে কত সুখের ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিপদগামী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনতে আর পরিবারগুলোকে শান্তিময় করার লক্ষ্যে একজন আলেম অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু তারা তা না করে কীভাবে সহজে ভাইরাল হয়ে অর্থ উপার্জন করবেন সেই চিন্তায় ওয়াজে কখনও হিন্দি গানের সুর টানেন আবার কখনও বাংলা গানের। প্রত্যেক আলেমের কয়েকটি করে চ্যানেল থাকে সেগুলোতে মিথ্যা হেডলাইন দিয়ে এসব বক্তব্য প্রচার করে ছড়িয়ে দেন। যেহেতু তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে দ্বীনের পথে আনা নয় তাই তাদের এসব ওয়াজ মানুষের আধ্যাত্মিক পরিবর্তনে কোন প্রভাব ফেলে না। এছাড়া এই নামধারী আলেমরা মানুষকে যে নসীহত করেন তা নিজেই পালন করেন না। বিশ্বনবী (সা.) যে পশুতুল্য মানুষকে ফেরেশতায় রূপায়ীত করেছিলেন, তা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? তা হয়েছিল কেবলমাত্র তার উত্তম আদর্শ, উত্তম নসিহত আর অন্ধকার রাতের দোয়া। তিনি তার উম্মতকে যে নসীহত করতেন প্রথমে তা নিজে আমল করে দেখাতেন। যার ফলে তার নসীহত জাদুর মত কাজ করতো। তাই যারা ওয়াজ নসীহত করেন তাদেরকে প্রথমে হতে হবে উত্তম আদর্শের। যারা সমাজের পথপ্রদর্শক তাদের আদর্শ হতে হবে সবার চেয়ে উত্তম। একজন আদর্শবান ইমাম হচ্ছেন সমাজ ও দেশের বড় মূল্যবান সম্পদ।
এক জন আদর্শবান ইমাম চেষ্টা করলে পারেন গোটা সমাজকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে। মহানবী (সা.) ও তার খলীফাদের মৃত্যুর পর ইসলামের প্রচার প্রসার ইমামদের মাধ্যমেই হয়েছিল। ইসলামের আদর্শবান ইমামরা প্রকৃত ইসলামকে প্রচার করে কায়েম করেছিলেন একটি আধুনিক সমাজ ও দেশ। যিনি প্রকৃত আলেম তিনি সত্য বলতে কখনও দ্বিধা করবেন না এবং যা অন্যকে পালন করতে বলবেন তা প্রথমে নিজে করবেন। ইসলামি শিক্ষা এক মুসলমানকে শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী এবং মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই শিক্ষা ভুলে পরস্পর হানাহানির নীতি কোনো ক্রমেই ইসলাম সমর্থন করে না। ওয়াজ নসীহতে ফিরে আসুক প্রাণ আর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে গড়ে উঠুক সম্প্রীতির মেলবন্ধন"