নিয়ামতপুর নওগাঁ: চুনের ফোঁটা পানের বোটা এইদিক দিয়ে হলো মনসার ঘ্যাটা'(পথ)। এই কথা বলে কারিগর বিশ্বকর্মা মা মনসার চাপে বেহুলা লখিন্দরের লোহার বাসর ঘরে ছোট একটি ছিদ্র করে দেন। সেই ছিদ্র দিয়ে মা মনসার পাঠানো একটি সাপ লখিন্দরকে দংশন করে।
সাপের দংশনে নিহত লখিন্দরকে ভাসিয়ে দেয়া হলো কলার ভেলায়। মৃত লখিন্দরের পাশে সদ্য বিধবা বেহুলা। ছুটে চললো ভেলা। সঙ্গে সঙ্গে নারী দর্শকরা আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। এমনই দৃশ্য দেখা গেল গত বৃহস্পতিবার রাতে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা গ্রামের একটি মনসা পালার আসরে। গ্রামের সুফল চন্দ্রের উঠানে "জাগর" উপলক্ষে বসেছিল এই গানের আসর। হিন্দু শাস্ত্রে আঠারটি পুরাণ রয়েছে। পদ্মপুরাণ হচ্ছে তৎমধ্যে একটি। এই পুরাণের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা। মনসা হচ্ছে শিবের কন্যা। সমুদ্র মন্থনের সময় শিব বিষ পান করেছিলেন এবং সেই বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত করেছিলেন মা মনসা।
এরপর থেকে মনসাকে বিষহরিও বলা হয়। পদ্মপুরাণ-এর মূল উপজীব্য চাঁদ সদাগরের উপর দেবী মনসার অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান। এই গানের প্রধান নির্দেশক নিবারণ চন্দ্র পাল। স্থানীয় ভাষায় তাকে 'মূল গ্যানা' বলা হয় ৬৪ বছর ধরে তিনি এই গানের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি জানালেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা মনসা পূজা ও বিভিন্ন মানত উপলক্ষে এই গানের আয়োজন করে থাকেন। তখন তারা গ্রামে গ্রামে এই গান করে থাকেন। তার দলে ১৫- ১৬ জন সদস্য রয়েছেন। তার নির্দেশনায় সবাই অভিনয় করে। তিনি মূলগান সুরে সুরে উপস্থাপন করেন। অভিনয় শিল্পীরা তার গানের তালে তালে নৃত্য করেন এবং নিত্য শেষে বিভিন্ন অভিনয় করেন। অভিনয় শিল্পীরা কখনো সেজেগুজে মেকাপ নিয়ে অভিনয় করেন আবার কখনো সাধারণ বেশে মেকআপ ছাড়াই অভিনয় করেন।
তিনি আরো জানালেন, সারাবছর অনুষ্ঠিত হলেও সাধারণত জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র এবং মাঘ- ফাল্গুন মাসে এই গান বেশি হয়। শ্রাবণ ভাদ্র মাসে মনসা পূজা উপলক্ষে এই গান বেশি হয় আর মাঘ- ফাল্গুন মাসে বিয়ের মানত উপলক্ষে এই গানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এই গানকে 'জাগরের' গান বলা হয়। অভিনয় শিল্পীরা সেজেগুজে ও মেকআপ নিয়ে অভিনয় করলে তাকে 'সাজানো গান 'বলা হয়। 'সাজানো গান' পরিবেশিত হলে দর্শক বেশি হয় বলে জানালেন তিনি। নিবারণ চন্দ্র পাল জানালেন, এখনো গ্রাম অঞ্চলের মানুষ এই মনসার গান মনোযোগ দিয়ে শুনেন। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে মানুষের হাতে কোন কাজ থাকে না তখন দর্শক বেশি হয়। মহিলা দর্শকরা এই গান বেশি শুনে থাকেন । তিনি জানালেন, এই গান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শুরু হয়ে মধ্যরাত অবধি চলে বন্ধ হয়ে যায়। গানের বাকি অংশ পরেরদিন সকালে শুরু হয়ে দুপুরে শেষ হয়। এই গান শুনতে এসেছিলেন গ্রামের বাসিন্দা প্রীতম মন্ডল। তিনি ডাক বিভাগে পোস্টাল অপারেটর পদে চাকরি করেন। তিনি জানালেন, চাকরির সুবাদে গ্রামে আর থাকা হয়না। অনেক ছোটকাল থেকেই আমি এই গান শুনি। সন্ধ্যায় গ্রামে এসে শুনলাম এখানে গান হচ্ছে। তাই বন্ধুদের সঙ্গে গান শুনতে আসলাম।
গ্রামের বাসিন্দা ও ভাবিচা ইউপি সদস্য তুশিত কুমার সরকার জানালেন, সময়ের বিবর্তনে এই মনসার পালা আয়োজন অনেক কমে গেছে। কিছুকিছু এলাকায় মাঝেমাঝে এই গান গানের আয়োজন করা হয়। তিনি আরও বলেন, লোকসংস্কৃতির এই আয়োজন টিকে থাকুক যুগ-যুগান্তর।